শাস্ত্রসম্মতভাবে জীবের চেতনা মূলত তিন প্রকার। এই চেতনার প্রকারভেদকে শাস্ত্রগুলোতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, বিশেষ করে উপনিষদ, ভাগবত ও ভগবদ্গীতা-তে।
জীবের চেতনার তিন প্রকার (ত্রিধা চেতনা)
১️. অচেতন (জড়)
যা সম্পূর্ণভাবে চেতনাশূন্য বা জড়।
উদাহরণঃ পাথর, লোহা, কাঠ।
এদের মধ্যে কোনো প্রকার জ্ঞান, অনুভূতি বা সচেতনতা থাকে না।
শাস্ত্রীয় ভিত্তি:
গীতা ৭.৪
ভূমির্বাপোন্নলো বায়ুঃ খং মনোবুদ্ধিরেব চ।
অহঙ্কার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিৰষ্টধা॥অনুবাদঃ ভূমি (পৃথিবী), জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহংকার – এই আট প্রকার প্রকৃতি আমার জড় প্রকৃতি।
২️. অসচ্ছেতন (সীমিত চেতনা)
জীবাত্মার সীমিত চেতনা, যা জড় দেহের দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে।
উদাহরণ: পশুপাখি, গাছপালা, জীবজন্তু।
চেতনা থাকলেও তারা সম্পূর্ণ আত্ম-সচেতন নয়, বরং প্রাকৃতিক প্রবৃত্তির দ্বারা চালিত।
শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা:
বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪.৩.৩৫
স যথানন্দময় আত্মা।"আত্মা চেতনা-অচেতনার মধ্যবর্তী অবস্থায় থাকে।"
শ্রীমদ্ভাগবত ১১.২.৩৭
যস্যাত্মবুদ্ধিঃ কুণপে ত্রিধাতুকে।
স্বধীঃ কলত্রাদিষু ভৌম ইজ্যধীঃ।
যতীর্থবুদ্ধিঃসলিলে নকরচেতসা।
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি তিন ধাতুর (বাইল, কফ, বাত) দ্বারা গঠিত এই দেহকেই আত্মা মনে করে, নিজের পরিবার-পরিজনকেই আত্মার আত্মীয় ভাবে, এবং গঙ্গাজলের মতো তীর্থকেই পবিত্র ভাবে, সে গরু ও গাধার মতো মূর্খ।
৩️. পূর্ণচেতনা (অদ্বিতীয় চেতনা)
কেবলমাত্র পরমেশ্বর এবং মুক্ত আত্মা-দের মধ্যে থাকে।
মুক্ত জীবাত্মা বা সিদ্ধ পুরুষরা এই চেতনা লাভ করে, যা শুদ্ধ আত্মচেতনা ও কৃষ্ণচেতনা।
উদাহরণঃ শ্রীকৃষ্ণ, পরমপুরুষ, শুদ্ধভক্ত।
শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যাঃ
শ্রীমদ্ভাগবত ১.২.৬
স বৈ পুংসাং পরো ধর্মো যতো ভক্তিরধোক্ষজে।
অহৈতুকী অপরতিহতা যয়া আত্মা সুপ্রসীদতি॥অনুবাদঃ শ্রেষ্ঠ ধর্ম হল সেই যা ভগবানের প্রতি নিঃস্বার্থ ও নিরবিচ্ছিন্ন ভক্তিরূপ। এই ভক্তির মাধ্যমে আত্মা শান্তি ও পরিতৃপ্তি লাভ করে।
গীতা ১৮.৬৬
সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপে ভ্যো মক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ॥
অনুবাদঃ সব ধর্ম ত্যাগ করে কেবল আমার শরণ নাও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্তি দেবো। ভয় করো না।
চেতনার প্রকার - বিবরণ - উদাহরণ
১. জড় চেতনা - সম্পূর্ণ চেতনাশূন্য - পাথর, কাঠ, ধাতু
২. সীমিত চেতনা - আংশিক/অসচ্ছেতনা - পশুপাখি, গাছ
৩. পূর্ণচেতনা - শুদ্ধ আত্মজ্ঞান ও কৃষ্ণচেতনা - মুক্ত আত্মা, ভক্ত, ভগবান
উপসংহারঃ
জীব চেতনা দ্বারা অনুপ্রাণিত, কিন্তু সেই চেতনার স্তরভেদ নির্ভর করে তার আত্ম-অবস্থার উপর। আমরা সবাই চেষ্টা করি সীমিত চেতনা থেকে মুক্ত হয়ে শুদ্ধ চেতনার দিকে অগ্রসর হতে, শ্রীকৃষ্ণচেতনা লাভ করতে।